অ্যাভোকেডো : পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল
ড. বাবুল চন্দ্র সরকার
অ্যাভোকেডো একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল। পুষ্টিসমৃদ্ধ ফল সমূহের মধ্যে অ্যাভোকেডো অন্যতম। অ্যাভোকেডো উষ্ণ ও অবউষ্ণম-লীয় একটি উদ্ভিদ। এটিকে নতুন পৃথিবীর ফল বলা হয়। এ ফলটি চর্বি, প্রোটিন এবং খনিজ সমৃদ্ধ এবং এতে স্বল্প মাত্রার কার্বোহাইড্রেট থাকে। প্রধান ফ্যাটি এসিডগুলো হলো অলিক, পামিটিক এসিড এবং লিনোলেনিক এসিড। তবে ফ্যাটি এসিড কম্পোজিশন জাত, পরিপক্বতার পর্যায় ও ভৌগোলিক অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। পাকা ফল সালাদে ব্যবহৃত হয়। আইসক্রীম এবং মিল্কসেক (সরষশ ংযধশব) এ অ্যাভোকেডো ব্যবহৃত হয়। এমনকি পাল্প ফ্রিজ এ সংরক্ষণ করা যায়। অ্যাভোকেডোর উৎপত্তি মধ্য আমেরিকায়। ভারতে এটি ৫০-৭৫ বৎসর পূর্বে প্রবর্তিত হয়। বর্তমান বিশ্বে মেকি্রাকো, ইউএসএ, ডমিনিকান রিপাবলিক, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া, হাইতি, ভেনিজুয়েলা, চিলি এবং দক্ষিণ আফ্রিকা হচ্ছে প্রধান অ্যাভোকেডো উৎপাদনকারী দেশ। অ্যাভোকেডো খধঁৎধপবধব পরিবারভুক্ত একটি ফল। এর প্রায় ৪৭টি গণ ও ১৯০০ প্রজাতি রয়েছে।
জাত
নতুন বিশ্বে বেশ কিছু জাত চাষ হয় যেমন: ঋঁবৎঃব, ঐধংং, খঁষধ, চড়ষষড়পশ, অৎফরঃয ইত্যাদি। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে বারি অ্যাভোকেডো-১ নামে একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে।
বারি অ্যাভোকেডো-১ জাতের বৈশিষ্ট্য
উচ্চফলনশীল ও নিয়মিত ফলদানকারী। গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ১৮০-২০০টি। টিএসএস ১৪.৬%; ফলের রং গাঢ় সবুজ এবং উপবৃত্তাকার; প্রতিটি ফলের গড় ওজন ৫৬২ গ্রাম এবং গড় খাদ্যোপযোগী অংশ ৬৮%; প্রতিটি ফলে বিটা-কেরোটিনের পরিমাণ ৫৭.২ মি. গ্রাম/১০০ গ্রাম এবং দেহের জন্য উপকারী চর্বি লিনোলিক/ওমেগা-৬ (অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড) এর পরিমাণ ২০.২%।
ফুল ও ফল ধারণ
বীজের গাছ থেকে ফুল ও ফল হতে ৫-৬ বছর লাগে। কিন্তু কলমের গাছ ৩-৪ বছর বয়স থেকে ফল রাখা যুক্তিযুক্ত। নিম্ন দিবস (২০০ সে.) ও রাতের (১৫-১৫০ সে.) তাপমাত্রা ফুল ফোটাকে ত্বরান্বিত করে। দিনের তাপমাত্রা ২৫-৩০০ সে. হলে ফুল ফোটা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি দিনে ১ ঘন্টাও যদি ৩০০ সে. তাপমাত্রা থাকে তবে ফুল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।
অ্যাভোকেডোর জাতগুলোকে ফুলে প্রস্ফুটিত হওয়ার উপর ভিত্তি করে ২ ভাগে ভাগ করা হয়; এ টাইপ ও বি টাইপ।
এ টাইপ জাত
সকাল বেলায় ফুলটি কার্যকর স্ত্রী হিসেবে ফোটে এবং দিনের মধ্যভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পুনরায় পরবর্তী দিনের বিকেল বেলায় কার্যকর পুরুষ হিসেবে ফোটে।
বি টাইপ জাত
বিকেল বেলায় ফুলটি প্রথমে স্ত্রী হিসেবে ফোটে এবং দ্বিতীয় দিনের সকাল বেলায় পুনরায় পুরুষ হিসেবে ফোটে।
মাটি
অ্যাভোকেডো সঠিক নিকাশযুক্ত বেলে থেকে কর্দম দোআঁশ যে কোন প্রকার মাটিতে চাষ করা যায়। গভীর দো-আঁশ বা উর্বর মাটি অ্যাভোকেডো চাষের জন্য সর্বোত্তম। তবে এটি পাহাড়ের ঢালে এবং জলাধারসংলগ্ন উঁচু জায়গাতেও ভাল জন্মে। এটি অ¤ীøয় মাটিতে (পিএইচ- ৪.৫-৫.৫) সবচেয়ে ভালো জন্মে। কিন্তু কিছু ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান রেস এর রুটস্টক ক্যালকেরিয়াস ক্ষারীয় মাটিতে (পিএইচ-৭.৬-৭.৯) জন্মাতে পারে।
জলবায়ু : ভারতের তামিলনাড়–তে গড় সর্বোচ্চ ও গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্র যথাক্রমে ২৭-২০ সে. থেকে ৩৩.৯০ সে. এবং ১৪.৯০ সে. থেকে ২২.২০ সে এ অ্যাভোকেডো ভালো জন্মে। অ্যাভোকেডোতে নিম্নতাপমাত্রা ফুল ধারণকে বৃদ্ধি করে।
বংশবিস্তার
বীজ দ্বারা বংশবিস্তার করা যায় তবে এতে জাতের বিশুদ্ধতা বজায় থাকেনা। এজন্য অংগজ উপায়ে এর বংশ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এর বীজের সজীবতা দ্রুত (২-৩ সপ্তাহ) নষ্ট হয়ে যায়। বীজের আবরনটি সরিয়ে বপন করলে অংকুরোদগম তাড়াতাড়ি হয়। রুটস্টক তৈরির জন্য বীজ ব্যবহৃত হয়। একটি বীজকে ভ্রুণসহ প্রয়োজনে ৪-৬ টি ভাগে ভাগ করে ভিন্ন ভিন্ন টবে বা বেডে স্থাপন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে বেডে বীজ থেকে বীজ ৩৫-৪৫ সেমি. এবং সারি থেকে সারি ৬০-৭৫ সে. মি. দূরত্ব বজায় রেখে বীজ বপন করতে হবে। বীজের উপর ১ সেমি. এর বেশি মাটি দেয়া যাবেনা। বীজ থেকে চারা গজাতে ৫৫-৯৫ দিন সময় লাগে।
কাটিং, বাডিং এবং গ্রাফটিং এর মাধ্যমে অঙ্গজ বংশবিস্তার করা যায়। তবে গ্রাফটিং এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করা ভালো। সাধারণত জুন-জুলাই মাসে ফাটল গ্রাফটিং পদ্ধতিতে মাতৃগাছের গুণাগুণ সম্পন্ন চারা গাছ উৎপাদন করা যায়।
গ্রাফটিং এর উপযুক্ত সময় ও পদ্ধতি
জুন-আগস্ট মাসে এক বছর বয়সী অ্যাভোকেডো রুটস্টকের উপর ছয় মাস বয়সী উপযুক্ত সায়ন ক্লেফট/ফাটল গ্রাফটিং এর মাধ্যমে জোড়া লাগাতে হবে, জোড়া লাগানো স্থানসহ সম্পূর্ণ সায়নটি পলিথিন ক্যাপ দ্বারা ঢেকে বেঁধে দিতে হবে যাতে এটি শুকিয়ে না যায়; অতঃপর কলমগুলো ৭ দিন অন্ধকার পরিবেশে রেখে দিতে হবে; অন্ধকার পরিবেশ থেকে বের করে ছায়াযুক্ত স্থানে রাখলে ৩০ দিনের মধ্যে কলমগুলো সফলভাবে জোড়া লেগে যায়; এভাবে তৈরিকৃত ৮০ শতাংশ অ্যাভোকেডো কলম সফল হয় এবং পরবর্তী এক বছরে মাঠে রোপণের উপযুক্ত হয়।
রোপণ
মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত চারা লাগানোর উত্তম সময় তবে যদি সেচ সুবিধা থাকে তাহলে সারা বছরই চারা লাগানো যায়। সাধারণত জাতের তেজ (ঠরমড়ঁৎ) এবং দৈহিক বৃদ্ধি বিবেচনায় অ্যাভোকেডো এর স্বাভাবিক রোপণ দুরত্ব ৮-১০ মিটার। চারা রোপণের ১৫-২০ দিন পূর্বে সাধারণত ৮ মি.ঢ৮ মি. দূরত্বে ৬০ সেমি.ঢ৬০ সেমি.ঢ৬০ সেমি. আকারের গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তের মাটির সাথে ১০-১৫ কেজি জৈবসার এবং ১৫০ গ্রাম টিএসপি ভালভাবে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। মাটিতে রস কম থাকলে গর্তে পানি দিতে হবে। গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর নির্বাচিত চারা গোড়ার মাটির বলসহ গর্তের মাঝখানে সোজাভাবে লাগিয়ে চারদিকের মাটি দিয়ে গোড়ায় মাটি সামান্য চেপে দিতে হবে। চারা রোপণের পর পানি, খুঁটি এবং বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। জলাবদ্ধমুক্ত জমিতে অবশ্যই অ্যাভোকেডো রোপণ করতে হবে।
সেচ
সর্বোচ্চ ফলন ও ফলের বিকাশের জন্য মাটিতে পর্যাপ্ত আর্দ্রতা/রস থাকা আবশ্যক। যদি শুষ্ক মৌসুম দীর্ঘ সময় বৃষ্টিপাত না হয় তবে ফলন বৃদ্ধি করার জন্য সেচ দিতে হয়। এ জন্য খরা মৌসুমে অ্যাভোকেডো বাগানে ২-৩টি সেচ দেয়া প্রয়োজন। অ্যাভোকেডো গাছ তাদের প্রয়োজনীয় ৯০-৯৫% পানি মাটির ০-৬০ সেমি. গভীরতা থেকে সংগ্রহ করে। ইসরাইলে এক গবেষণায় দেখা গেছে ২১ দিন পর সেচ দিয়ে ফলে উচ্চ মাত্রায় তেলসহ উচ্চফলন পাওয়া গেছে এবং আগাম ফল সংগ্রহ করা গেছে। বর্ষাকালে অথবা অন্য কোনভাবে গাছের গোড়ায় যাতে পানি জমতে না পারে সেজন্য অতিরিক্ত পানি দ্রুত নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা করতে হবে।
সার প্রয়োগ
অ্যাভোকেডো চাষের জন্য নাইট্রোজেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শরৎকালে হালকা মাটিতে ফসফরাস ও নাইট্রোজেন এর প্রয়োগ ফলন বৃদ্ধি করে। ১-২ বছর বয়সের গাছে পঁচা গোবর ১৫ কেজি, ইউরিয়া ২৫০ গ্রাম, টিএসপি ২৫০ গ্রাম, এমওপি ২০০ গ্রাম, জিপসাম ১০০ গ্রাম ও বরিক এসিড ৫০ গ্রাম; ৩-৫ বছর বয়সের গাছে পঁচা গোবর ২০ কেজি, ইউরিয়া ৪০০ গ্রাম, টিএসপি ৩৫০ গ্রাম, এমওপি ৩০০ গ্রাম, জিপসাম ১৫০ গ্রাম ও বরিক এসিড ৬০ গ্রাম এবং ৬ এর অধিক বছর বয়সের গাছে পচা গোবর ২৫ কেজি, ইউরিয়া ৫০০ গ্রাম, টিএসপি ৪০০ গ্রাম, এমওপি ৩৫০ গ্রাম, জিপসাম ২০০ গ্রাম ও বরিক এসিড ৭০ গ্রাম হারে সার প্রয়োগ করতে হবে। উল্লিখিত সার সমান তিন কিস্তিতে গাছের গোড়া হতে কিছু দূরে ছিটিয়ে কোদাল দ্বারা কুপিয়ে বা চাষ দিয়ে মাটির সাথে ভালভাবে মিশিয়ে দিতে হবে। পাহাড়ের ঢালে ডিবলিং পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। প্রথম কিস্তি বর্ষার প্রারম্ভে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে (এপ্রিল-মে), দ্বিতীয় কিস্তি মধ্য ভাদ্র থেকে মধ্য কার্তিক (সেপ্টে¤¦র-অক্টোবর) মাসে এবং তৃতীয় কিস্তি মাঘ-ফাল্গুন (ফেব্রুয়ারি) মাসে প্রয়োগ করতে হবে।
আগাছা-রোগ-পোকা দমন
গাছের পর্যাপ্ত বৃদ্ধি ও ফলনের জন্য সবসময় জমি পরিষ্কার বা আগাছামুক্ত রাখতে হবে। বিশেষ করে গাছের গোড়া থেকে চারদিকে ১ মিটার পর্যন্ত জায়গা সবসময় আগাছামুক্ত রাখতে হবে। সাধারণত বারি অ্যাভোকেডো-১ জাতটিতে রোগ ও পোকামাকড় এর আক্রমণ তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না।
পোকা মাকড়
এতে স্কেল পোকা, মিলিবাগ ও মাইট এর প্রকোপ দেখা দিতে পারে। কার্বারিল গ্রুপের কীটনাশক (যেমন সেভিন ডব্লিউপি বা অন্য নামের) প্রতি লিটার পানিতে ২.০ গ্রাম হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২-৩ বার স্প্রে করে স্কেল পোকা ও মিলিবাগ দমন করা সম্ভব।
এবামেকটিন গ্রুপের মাকড়নাশক (ভার্টিম্যাক বা অন্য নামের) ১.৫ গ্রাম/লিটার হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ব্যবহার করা মাইট দমন করা সম্ভব।
রোগ
অ্যাভোকেডো ফলের দাগ (ঋৎঁরঃ ংঢ়ড়ঃ) রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয়। এর ফলে কচি ফল ঝরে পড়তে পারে। ম্যানকোজেব গ্রুপের ছত্রাকনাশক যেমন: ইন্ডোফিল এম-৪৫ ২ গ্রাম/ ১ লিটার পানি এই হারে মিশিয়ে স্প্রে করতে হবে। শিকড় পচা (ৎড়ড়ঃ ৎড়ঃ) রোগ অ্যাভোকেডোর সবচেয়ে মারাত্মক রোগ। এতে গাছ মারা যায়। রিডোমিল গোল্ড গাছের চারপাশে মাটিতে প্রয়োগ করে এ রোগ নিরাময় করা সম্ভব।
ফল সংগ্রহ
ফল সংগ্রহের সময় আগস্ট-অক্টোবর মাস পর্যন্ত। সাধারণত ফলে তেলের ও শুষ্ক পদার্থের পরিমাণ এর উপর ভিত্তি করে ফল সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। এটি ক্লাইমেকটেরিক ফল বিধায় শারীরবৃত্তীয় পরিপক্বতায় সংগ্রহ করলে ৬-১২ দিনের মধ্যে পেকে যায়।
ফলন
ফল হাত দ্বারা বা বড় গাছের ক্ষেত্রে লম্বা হারভেস্টার দ্বারা সংগ্রহ করা হয়। ফল সংগ্রহের সময় যেন আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। বারি অ্যাভোকেডো-১ জাতটির হেক্টর প্রতি গড় ফলন প্রায় ১০.৬ টন ও গাছপ্রতি ফলের সংখ্যা ১৮০-২০০টি।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, ফল বিভাগ, এইচআরসি, বিএআরআই, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১৬০০৯৩১৯ ই-মেইল : bsarker_64@yahoo.com